বাংলাদেশের সর্ব উত্তরে অবস্থিত কুড়িগ্রাম জেলা। বিগত কয়েক বছর সংবাদমাধ্যমগুলোতে আলোচিত হয়েছে মঙ্গাপীড়িত হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর এলাকা হিসেবে। অথচ এ এলাকাতেই যে দেশের অন্যতম বৃহৎ খনিজ পদার্থের মজুদ লুকায়িত আছে, তা সম্ভবত কেউই ভাবেননি। ভূতাত্ত্বিক জরিপের মাধ্যমে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের বালিতে ধাতব খনিজ পদার্থের বিশাল মজুদ বিদ্যমান। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের কয়েকজন ভূতত্তবিদ বেশ কয়েক বছর আগে কুড়িগ্রামের এ খনিজ বালির অবস্থান আবিষ্কার করেন।এসব মূল্যবান খনিজ পদার্থের মধ্যে রিউটাইল, জিরকন, গারনেট, ইলমেনাইট, কায়ানাইট, মোনাজাইট ও ম্যাগনেটাইট অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার একটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে এ সম্পদের অর্থনৈতিক ও উত্তোলন-সম্ভাব্যতা যাচাই করার লক্ষ্যে অনুসন্ধানের অনুমতি প্রদান করে। বিশ্ববাজারে এসব খনিজ পদার্থের চাহিদা ও মূল্য বিপুল এবং আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতার বহুবিধ শিল্প এসব খনিজ পদার্থ ছাড়া চলতে পারে না।
১৯৬২ সালে কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে আবিষ্কৃত একই ধরনের খনিজ বালির অবস্থান সম্পর্কে অনেকেই অবগত আছেন। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, কুড়িগ্রামে এ খনিজ বালির মজুদ কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকার মজুদের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি। কেবল তা-ই নয়, কুড়িগ্রামের এই খনিজ বালির মজুদ বিশ্বে সেরা খনিজ বালির মজুদের সমতুল্য।
কেমন করে সৃষ্টি হলো এ মূল্যবান খনিজ বালির মজুদ? বহুযুগ ধরে ব্রহ্মপুত্র নদটি প্রবাহিত পানির সঙ্গে আনীত বালী তার বক্ষে ধারণ করতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে তলদেশে পুরু আকারের বালিস্তর জমা করে। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের মূল্যবান খনিজ পদার্থসমৃদ্ধ পাহাড়ি পথকে ক্ষয় করে ব্রহ্মপুত্র নদ এ মূল্যবান বালি জোগাড় করে এবং বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় প্রবেশ করে নদীবক্ষে তা জমা হয়। এক ভূতাত্ত্বিক জরিপে প্রতীয়মান হয়, বিগত ২৮ হাজার বছরে নদীবক্ষে এ রকম প্রায় ৫০ মিটার বালিস্তর জমা হয়েছে। সাধারণ বালির আকারে এলেও এর ভেতর মূল্যবান খনিজ পদার্থকণার আধিক্য তাকে সাধারণ বালি থেকে আলাদা করে দেয়। আর এভাবেই যুগের বিবর্তনে জমা হয় মূল্যবান খনিজ বালির এ সম্ভার। বিশেষজ্ঞ মহল এ মত প্রকাশ করেছেন যে কুড়িগ্রামে প্রাপ্ত এ বিরাট খনিজ মজুদকে যথাযথভাবে খনন, আহরণ ও বাজারজাত করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় আকারের সহায়তা বয়ে নিয়ে আসবে।
বাংলাদেশের খনিজসম্পদ আহরণ ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা সব ক্ষেত্র সুখকর নয়, তা বিগত বছরগুলোর কার্যক্রম থেকে প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে বিদেশি কোম্পানিকে দেশের খনিজসম্পদ উন্নয়নে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব চুক্তি সম্পাদন করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে দেশীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়। এ কথা যদিও সঠিক যে বিদেশি আধুনিক প্রযুক্তি খনিজসম্পদ আহরণে প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে দেশীয় স্বার্থ সমুন্নত না রাখলে তার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হতে বাধ্য। বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো দেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী কস্ট রিকভারি নামে যে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে যায়, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। একইভাবে দেশের কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মাত্র ছয় শতাংশ রয়্যালটি বাংলাদেশ পাবে মর্মে যে চুক্ত করা হয়, তার পরিণতি আমরা দেখতে পাই বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর আত্মাহুতির মাধ্যমে।
কুড়িগ্রামের খনিজ বালির অর্থনৈতিক ও উত্তোলন-সম্ভাব্যতা যাচাই করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কাবর্ন মাইনিং নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে অনুসন্ধানের অনুমতি প্রদান করেছে এবং কোম্পানিটি এ লক্ষ্যে বতর্মানে কাজ করছে। ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে বালির চর এলাকায় চার হাজার হেক্টর জমিতে এই কাজ চলছে। প্রাথমিক জরিপে ইতিবাচক ফল পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটি আরও চার হাজার হেক্টর জমিতে অনুসন্ধানের জন্য আবেদন করে। জরিপ শেষে ইতিবাচক ফল পাওয়া সাপেক্ষে বাংলাদেশ এই কোম্পানিকে এ সম্পদ আহরণে নিয়োগ করলে একটি চুক্তির মাধ্যমে তা করতে হবে। সে ক্ষেত্র কী ধরনের চুক্তি হতে পারে? দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মূল্যবান খনিজের ১২ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে, আর ৮৮ শতাংশ পাবে বিদেশি কোম্পানিটি। এতে ফুলবাড়ী কয়লা চুক্তির মতোই আহরিত সম্পদের সিংহ ভাগ চলে যাবে কোম্পানির হাতে। প্রকৃতপক্ষে খনিজসম্পদ কোম্পানির হাতে অর্পণ করে কোবল রয়্যালটি নেওয়ার চুক্তি করলে বাংলাদেশ যথার্থ লাভবান হবে না। তার তুলনায় ‘জয়েন্টভেঞ্চার’ বা ‘উৎপাদনে অংশীদারত্ব’ পন্থায় খনিজসম্পদ উন্নয়নের চুক্তি করা দেশীয় স্বার্থ সংরক্ষনে অধিকতর সহায়ক। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট নীতিমালা।
আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। উদাহরণ হিসেবে কুড়িগ্রামে পাওয়া রিউটাইল নামক খনিজ বালিটির কথা ধরা যাক। রিউটাইলের বাজারমূল্য প্রতি টন ৪৬৫ ডলার। রিউটালের প্রধান ব্যবহার বিশেষ রং তৈরিতে এবং এই রিউটাইল রঙের বাজারমূল্য প্রতি টন ১৫ হাজার ডলার। সুতরাং কোম্পানি রিউটাইল বালি নিয়ে গিয়ে তার দেশে রং তৈরি করে লাভ করবে অনেক অনেক গুণ বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ নিজে একটি রিউটাইল রং তৈরির প্লান্ট বসিয়ে একইভাবে অনেক গুণ বেশি লাভ করতে পারে। অথবা ধরা যাক অপর খনিজ জিরকনের কথা। দুই টন জিরকনের দাম এক হাজার ৪২৪ ডলার। অথচ প্রসেস প্লান্টের মাধ্যমে এর থেকে প্রাপ্ত এক টন জিরকনিয়ামের দাম ২২ হাজার ডলার। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে আহরিত খনিজ সরাসরি কোম্পানিকে না দিয়ে নিজ দেশে প্রক্রিয়াজাত করে প্রাপ্ত উপাদান ভাগাভাগি করার শর্ত আরোপ করা, যা কিনা দেশের জন্য অনেক গুণ লাভ বয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু এহেন শর্ত আরোপের বাধ্যবাধকতা না থাকলে কোম্পানি নানা কৌশলে তার স্বার্থে সহায়ক পন্থাটি অবলম্বনে চুক্তি করার ব্যবস্থা করবে। আর শর্তের বাধ্যবাধকতা কেবল দেশের খনিজ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমেই সম্ভব।
দেশের মূল্যবান সম্পদ, তা কয়লা হোক বা খনিজ বালি হোক, আহরণ ও উন্নয়নে বিদেশি উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন হতে পারে। টেকনোলজি ট্রান্সফার বা প্রযুক্তি হস্তান্তর দেশের স্বার্থে সহায়ক হয় তখনই, যখন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির ধারাগুলোতে সুস্পষ্টভাবে দেশীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখা হয়। আর এর জন্য দুটি আবশ্যক উপাদান হলো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা: যেমন কয়লানীতি বা খনিজনীতি এবং সৎ প্রশাসন। বাংলাদেশে বর্তমানে এ দুটি উপাদানই দৃশ্যত অনুপস্থিত।
No comments:
Post a Comment